Skip to main content

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদৌল্লা কলকাতা দখল করে নেবার পরে (২০ জুন) লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিলনাড়ু থেকে জাহাজযোগে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেন ও কোলকাতা পুনর্দখল করেন(২জানুয়ারি,১৭৫৭)। চন্দননগর দখল করার পরে সিরাজউদৌল্লাকে উৎখাত করার জন্য সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগত শেঠ প্রমুখদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন। চুক্তি মতো কাজ হয় ও নদীয়ার পলাশির প্রান্তরে সিরাজউদৌল্লার সঙ্গে প্রহসন মূলক যুদ্ধ হয়। সিরাজউদৌল্লা পরাজিত হয়ে পালাবার কালে ধরা পড়ে নিহত হন। চুক্তি মতো মীরজাফর নবাব হন এবং ক্লাইভ নগদ ত্রিশ লক্ষ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করেন। জায়গির থেকে ক্লাইভের বছরে তিন লক্ষ টাকা আয় হত। পরে ১৭৬০-এ ক্লাইভ দেশে ফিরে যান। এ দিকে তার অভাবে ইংরেজরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আবার ক্লাইভের ডাক পড়ে। ক্লাইভ এ দেশে আবার ফিরে আসেন ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি তখন দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন(১৭৬৫, আগস্ট ১)।বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে, নবাবের নামে মাত্র অস্তিত্ব থাকে। ফলে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়।সে বছর অত্যধিক বৃষ্টিপাত ও বন্যার গ্রাস থেকে কৃষক ফসল ঘরে তুলতে পারে নি। তদুপরি ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা এবং খাদ্যবাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের ফলে অবস্থার চরম অবনতি ঘটে। অথচ ব্রিটিশরাজের কোম্পানি শাসকরা পুরো বিষয়টিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে দাবি করে। কিন্তু ভিন্ন সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, ১৭৬৮ সনে আদায়কৃত রাজস্ব দেড় কোটি রুপির চেয়ে ১৭৭১ সনের আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ ৫,২২,০০০ রুপি বেশি ছিল, অথচ এর আগের বছরেই ঘটে যায় দুর্ভিক্ষ। এভাবে, কোম্পানি শাসনের সহযোগিতায়, খাদ্যশস্যের বাজার থেকে মুনাফা লুট এবং অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কারণে জনমানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছে। পরিণতিতে মারাত্মক দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকাগুলি হয়ে পড়ে জনশূন্য। জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, প্রায় ১০ মিলিয়ন(১ কোটি) মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। কৃষি উৎপাদন আর রাজস্ব আদায় অনুরূপহারে কমে যায়। দেশে দেখা দেয় চরম বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষ। কয়েক লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যান। এটাই ইতিহাসখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।

Comments

Popular posts from this blog

পুঁই মাচা__ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বাংলা গল্প

সহায়হরি চাটুয্যে উঠানে পা দিয়েই স্ত্রীকে বলিলেন-একটা বড় বাটি কি ঘটি যা হয় কিছু দাও তো, তারক খুড়ো গাছ কেটেছে, একটু ভালো রস আনি। স্ত্রী অন্নপূর্ণ খড়ের রান্নাঘরের দাওয়ায় বসিয়া শীতকালের সকালবেলা নারিকেল তেলের বোতলে ঝাটার কাটি পুরিয়া দুই আঙুলের সাহায্যে কাটার কাটিলগ্ন জমানো তৈলটুকু সংগ্ৰহ করিয়া চুলে মাখাইতেছিলেন। স্বামীকে দেখিয়া তাড়িতাড়ি গায়ের কাপড় একটু টানিয়া দিলেন মাত্র, কিন্তু বাটি কি ঘটি বাহির দিবার জন্য বিন্দুমাত্র আগ্রহ তো দেখাইলেনই না, এমনকি বিশেষ কোনো কথাও বলিলেন না। সহায়হরি অগ্রবর্তী হইয়া বলিলেন-কী হয়েছে, বসে রইলে যে? দাও না একটা ঘটি? আহ ক্ষেন্তি-টেন্তি সব কোথায় গেল এরা? তুমি তেল মেখে বুঝি ছোবে না? অন্নপূর্ণা তেলের বোতলটি সরাইয়া স্বামীর দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া রহিলেন, পরে অত্যন্ত শান্ত সুরে জিজ্ঞাসা করিলেন-তুমি মনে-মনে কী ঠাউরেছ বলতে পারো? স্ত্রীর অতিরিক্ত রকমের শান্ত সুরে সহায়হরির মনে ভীতির সঞ্চার হইল। ইহা -যে ঝড়ের অব্যবহতি পূর্বের আকাশের স্থিরভাব মাত্র, তাহা বুঝিয়া তিনি মরিয়া হইয়া ঝড়ের প্রতীক্ষায় রহিলেন। একটু আমতা আমতা করিয়া কহিলেন-কেন...কী আবার ....

ওয়ারেন হেস্টিংস এবং কর্ণওয়ালিসের সংস্কার

☼  হেস্টিংসের সংস্কার  [Warren Hastings’ Reforms] :-  [১৭৭২-৮৪ খ্রিস্টাব্দ] হেস্টিংস যখন ভারতে আসেন তখন আদর্শ শাসনব্যবস্থার কোনো দৃষ্টান্ত তাঁর কাছে ছিল না । তাই শাসন ও রাজস্ব সংক্রান্ত নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে হেস্টিংসের শাসনকাল অতিবাহিত হয়েছিল । নিজ প্রতিভা ও সাংগঠানিক ক্ষমতার জোরে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় শাসন ও রাজস্ব ব্যবস্থার যে রূপরেখা রচনা করে যান, প্রধানত তার উপরে ভিত্তি করে পরবর্তী গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ এক বলিষ্ঠ ও সুষ্ঠু কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন । পার্সিভ্যাল ও স্পীয়ারের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলা যায়, “যদি ক্লাইভ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন, তবে ওয়ারেন হেস্টিংস তাকে সংগঠিত করে একটি কার্যকরী সংস্থায় পরিণত করেছিলেন, আর কর্নওয়ালিশ আপন চিন্তা ভাবনা অনুযায়ী তাকে একটি সুসংহত ও সুনির্দিষ্ট রূপ দান করেছিলেন ।”    ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর আমলে (১) প্রথমেই দ্বৈত-শাসনব্যবস্থা লোপ করা হয় ও শাসনব্যবস্থা কোম্পানির তত্বাবধানে নিয়ে আসেন ।  (২) রাজস্ব আদায়কারী অত্যাচারী রেজা খাঁ ও সিতাব রায়কে পদচ্যুত করে ...